দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতা আর খুনোখুনিতে আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে রাজধানীর বাড্ডা এলাকা। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ছাড়াও আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা নিয়ে বিরোধ, অটোরিকশা চলাচলের রুটে চাঁদাবাজি, খাল ভরাট, বালুমহাল দখল, মাছের ঘের দখল, ডিশ ব্যবসা ও ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করাকে কেন্দ্র করে একের পর এক লাশ পড়ছে এই থানা এলাকায়।
শুধু আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বেই গত এক দশকে বাড্ডায় ১৯টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরের ৬ মাসেই খুন হয়েছেন ৭ জন। এসব খুনোখুনি ঘটছে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর প্রতিপক্ষের ভাড়া করা কিলারদের হাতে। সর্বশেষ, গত মাসেও উত্তর বাড্ডায় খুন হন বাড্ডা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ আলী।
ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে জড়িত স্থানীয় নেতা ছাড়াও বাড্ডায় সন্ত্রাসী হামলায় হতাহতের মধ্যে স্থানীয় বাসিন্দা এমনকি পথচারীও রয়েছেন। হত্যাকাণ্ডে জড়িত একাধিক সন্ত্রাসী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হলেও থামেনি খুনোখুনি। আসন্ন ঈদুল আযহায় পশুর হাটের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও একাধিক হত্যাকা- ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র বলছে, যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন, মালয়েশিয়া ও ভারতে বসে ভাড়াটে কিলারদের ব্যবহার করে এখানকার অপরাধ সা¤্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রুপ। পৃথক এসব গ্রুপের লিডারদের তালিকায় রয়েছেন মালয়েশিয়ায় পলাতক রবিন ও ডালিম, যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী মেহেদী ও সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চল, সুইডেনে থাকা নাহিদ এবং ভারতে অবস্থানরত আশিক। আর দেশে বসেই হত্যা-চাঁদাবাজির ঘুঁটি নাড়ছেন কাইয়ুম। কিলারদের ভাইবার, হোয়াট্স্অ্যাপ, আইএমও ও ম্যাসেঞ্জারে চাঁদাবাজি-খুনের নির্দেশ দিচ্ছেন এসব
গ্রুপলিডাররা।
জানা গেছে, গত ৩ মাসে স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন, আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলমের ভাই কামরুজ্জামান দুখু এবং ডিশ ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক ওরফে ডিশ বাবু হত্যাকা-ের নির্দেশনা এসেছে মালয়েশিয়া থেকে। আন্ডারওয়ার্ল্ড সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে প্রাণনাশের হুমকি পেয়ে সম্প্রতি নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করেছেন বাড্ডা থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বাবু এবং বর্তমান সভাপতি দিপু।
পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, বাড্ডা এলাকার সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হামলা থেকে র্যাব-পুলিশ সদস্যরাও রেহাই পাচ্ছেন না। গত দুবছরে অন্তত ৮ বার তাদের হামলার শিকার হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান পরিচালনাকারী দল। গত বৃহস্পতিবার ভোররাতে বাড্ডার সাঁতারকুল এলাকায় অভিযানে গিয়ে কিলার গ্রুপের হামলার শিকার হন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সদস্যরা। সেদিন
গোলাগুলিতে নিহত হন আওয়ামী লীগ নেতা ফরহাদ হোসেনের সন্দেহভাজন খুনি নুরুল ইসলাম ওরফে কিলার সানি ও অমিত ওরফে কিলার দাদা।
জানা গেছে, বিদেশে অবস্থানরত বড় ভাইদের নির্দেশে স্থানীয়ভাবে যারা বাড্ডার আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণকারী তাদের মধ্যে অন্যতম সজীব, আলমগীর, দুলাল, মাহবুব, তানভীর রনি, জাহাঙ্গীর, হাশেম, শুভ, রাসেল, ইদ্রিস, ইমন ও মামুন। বড় ভাইদের নির্দেশে তারাই সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে খুনোখুনি করেন। ছোট গ্রুপের অন্যতম সদস্য মাসুম, আরিফ, সাদ্দাম ছাড়াও কয়েকজন রয়েছেন। কারাগারে বসে রামপুরার শীর্ষ সন্ত্রাসী কাইল্লা পলাশ ও তার ভাগিনা তুষার এবং শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাজাদা নিজস্ব কিলার বাহিনী দিয়ে বাড্ডার অপরাধ জগতের কলকাঠি নাড়ছে এমন তথ্যও মিলেছে।
আরও জানা গেছে, বাড্ডায় সন্ত্রাসী কর্মকা-ের অন্যতম হোতা ভাগ্নে ফারুক, যে ইউপি চেয়ারম্যানের ভাই দুখু খুনের ঘটনায়ও অভিযুক্ত। আধিপত্য ধরে রাখতে ভাগ্নে ফারুক গ্রুপ ছাড়াও মেহেদী গ্রুপ, রায়হান গ্রুপ, ফরহাদ গ্রুপ, রবিন-ডালিম গ্রুপ, আলমগীর-জাহাঙ্গীর গ্রুপ, জয়নাল গ্রুপ, কাওসার গ্রুপ, বাদশা গ্রুপ ও অনিক গ্রুপের ক্যাডাররাও দাবড়ে বেড়াচ্ছে পুরো বাড্ডাজুড়ে। সন্ত্রাসী বাউল সুমনের মৃত্যুর পর তার অনুসারীরা এখন ভিড়েছে এসব গ্রুপে। তাদের হাতে নাকি অনেক আগ্নেয়াস্ত্র মজুদ আছে।
একসময় বাড্ডায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব ছিল যুবলীগ নেতা সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চলের। ২০১৩ সালের ২৯ জুলাই যুবলীগ নেতা রিয়াজুল হক মিল্কি হত্যার পর যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান তিনি। এলাকায় না থাকলেও তার গ্রুপের এখনো বেশ দাপট। চাঁদা ওঠানো হচ্ছে শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের নামেও।
জানা গেছে, বাড্ডা এলাকার জাগরণী ক্লাবে আলোচিত হত্যাকা-ের আগে আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ৩ গ্রুপের গোপন বৈঠক হয় মালয়েশিয়ায়। ওই বৈঠকের আয়োজন করেন মিল্কি হত্যা মামলার আসামি চঞ্চল। বৈঠকে অংশ নেয় জাগরণী ক্লাবে হত্যাকা-ে অভিযুক্ত পলাতক শীর্ষসন্ত্রাসী ডালিম গ্রুপ ও সজিব গ্রুপের সদস্যরা। বৈঠকের উদ্দেশ্যে চঞ্চল আমেরিকা থেকে প্রথমে মালয়েশিয়ায় ডালিম গ্রুপের কাছে যান। সেখানে বসেই তিনি বাংলাদেশে অবস্থানরত সজিবকে ডাকেন। তার ডাকে মালয়েশিয়ায় গিয়ে গোপন বৈঠকে যোগ দেন সজিব।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (উত্তর) উপ-কমিশনার মশিউর রহমান জানান, প্রবাসে বসে মূলত বাড্ডার অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করছে কয়েকজন সন্ত্রাসী। গত ১৫ জুন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ফরহাদ হোসেন খুন হন। তাকে গুলি করার পর লাল গেঞ্জি পরা এক যুবককে অস্ত্র হাতে পালিয়ে যেতে দেখা গেছে সিসিটিভি ফুটেজে। ফরহাদ হোসেন হত্যায় সরাসরি জড়িত সম্প্রতি বাড্ডার সাঁতারকুলে পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে নিহত কিলার সানি। একই রাতে গোলাগুলিতে নিহত হয় কিলার অমিতও। অমিত ভারতে ও আমেরিকায় পালিয়ে থাকা সন্ত্রাসী আশিক ও সন্ত্রাসী মেহেদীর সহযোগী। এলাকার দুশোর বেশি হিউম্যান হলার চলাচল ও ফুটপাথের নিয়ন্ত্রণ এবং গরুর হাটে চাঁদাবাজির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরেই মূলত ফরহাদ হোসেন খুন হন।